হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে শুরু হওয়া ভ্রমণের শেষ হলো ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে। মাঝে ৭২ বছরের জীবনের বেশির ভাগ সময় কাজ করে গেছেন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। ১৯৭৩ সালে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তার যোগ দেয়ার কথা ছিল সরকারি চাকরিতে। ট্রেনিংও শেষ করেছিলেন। কিন্তু মন সায় দিলো না। এটা যে তার
স্বপ্ন ছিল না। হাঁটলেন ভিন্ন পথে। বছর পাঁচেক পরই প্রতিষ্ঠা করলেন ‘আশা’।আশা আর সফিকুল হক চৌধুরীর জীবন, দুটোই উৎসর্গিত হলো গরিব মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে। মাঝে একবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী সফিকুল হক চৌধুরী গতকাল রাত ১টায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি… রাজিউন)। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান হয়েছে তার শেষ ঠিকানা। এরআগে শ্যামলীর শিশু পল্লী জামে মসজিদে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।মৃত্যু তো অমোঘ। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু সত্যিকারের শূন্যতা তৈরি করে। ছোট সংসার ছাপিয়ে তাদের জন্য হাহাকার তৈরি হয় সর্বত্র। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার সময় সফিকুল হক চৌধুরী রেখে গেছেন স্ত্রী, তিন পুত্রসহ বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা তার লাখ লাখ শুভাকাঙ্ক্ষীকে। এই মানুষেরাই তো ছিল তার বন্ধু, স্বজন। তাদের বিপদে-আপদে তিনি ছিলেন অকৃত্রিম সঙ্গী। বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বনির্ভর এনজিও আশার উপকারভোগী রয়েছেন দেশের সব জেলাতেই। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীর ১৩টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এর কার্যক্রম।
সফিকুল হক চৌধুরীর মৃত্যুতে দেশের কর্মসংস্থানে ও সমাজ সেবার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল বলে মনে করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের উন্নয়নে সফিকুল হক চৌধুরীর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি ছিলেন মানবিক, সদা হাস্যোজ্জ্বল ও মহৎ মনের অধিকারী। সফিকুল হক চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ও দৈনিক কালের খবর ও সাপ্তাহিক অপরাধ দূর্গের প্রধান সম্পাদক এম আই ফারুক আহমেদ। সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, আওয়াজ বা চাকচিক্য কম তবে ‘আশা’ দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা, যারা বিদেশি সহায়তা নির্ভর নয়। আশা ইন্টারন্যাশনাল ছড়িয়ে আছে বিশ্বময়। তার প্রয়াণ বড় শূন্যতা তৈরি করবে। তিনি তার আশা জাগানিয়া আশার মধ্যেই বেঁচে থাকবেন।
ফিরে দেখাআশা’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট মো. সফিকুল হক চৌধুরী ১৯৪৯ সালে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার নরপতি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে বি. এ (সম্মান) সহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ২০০৬ সালে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।সফিকুল হক চৌধুরী ১৯৭৮ সালে আশা প্রতিষ্ঠা করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শুরু হয় এক মহৎ কার্যক্রমের। আশার পুরো নাম এসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট। আশা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে উৎসাহ জোগায় এবং এ লক্ষ্যে তাদের সংগঠিত করে।১৯৭৮-১৯৮৫ সালে আশা দরিদ্র মানুষের জন্য বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে, আইনি সহায়তা প্রদান করে ও সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করে, সাংবাদিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করে এবং দারিদ্র্যবিমোচনে কাজ করে। ১৯৮৫-১৯৯১ সালে সংস্থাটি শিক্ষা, ঋণদান, ক্ষুদ্র কৃষি, নারী উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করে। বর্তমানে আশা ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের দরিদ্র নারীদের উন্নয়নে কাজ করে। এ ছাড়া আশা সদস্যদের সঞ্চয়, ক্ষুদ্র ইন্স্যুরেন্স ও চিকিৎসা অনুদান কার্যক্রম পরিচালনা করে।
আশা’র ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের উৎস হচ্ছে সংস্থারনিজস্ব অর্থ, সদস্যদের সঞ্চয় এবং পল্লী কর্মসংস্থান ফাউন্ডেশনের ঋণ। বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় আশা’র ব্রাঞ্চ অফিস ৩২৩৬টি, কর্মী ২৪ হাজার এবং সদস্য সংখ্যা ৫৫ লাখ। আশা ২০০৯ সালে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটে একটি প্রবীণ নিবাস প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সর্বস্তরের মানুষকে চিকিৎসা সেবা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও রেমিট্যান্স সেবা প্রদান করার জন্য একটি কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছে।
আশা ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়নে ‘আশা ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। ‘আশা ইন্টারন্যাশনাল’ মরিশাসে রেজিস্ট্রিকৃত। সিএমআই নামে নেদারল্যান্ডভিত্তিক ইক্যুইটি সংস্থা আশা ইন্টারন্যাশনালকে তহবিল সরবরাহ করছে। বর্তমানে আশা ইন্টারন্যাশনাল ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, ঘানা ও কম্বোডিয়ায় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আশা ২০০৭ সালে দরিদ্র ও নিম্নআয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্বল্প খরচে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দানের জন্য আশা ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চার হাজারেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী আশা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে।
ক্ষুদ্র ঋণের অন্যতম উদ্যোক্তা তিনি-ড. দেবপ্রিয়: সফিকুল হক চৌধুরীকে দেশে ক্ষুদ্র ঋণের অন্যতম উদ্যোক্তা উল্লেখ করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, তিনি জীবনের শুরু থেকেই দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায় ও দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের উদ্যোক্তা যারা আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে যারা অবদান রেখেছেন তাদের ভেতরও নিঃসন্দেহে অন্যতম তিনি। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রেখে গেছেন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, ক্ষুদ্রঋণকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের সামাজিক উদ্ভাবনী শক্তিকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছেন। শিক্ষা বিস্তারের জন্য আজীবন কাজ করেছেন। গরিব মানুষের আইনি অধিকারের জন্য কাজ করেছেন। সফিকুল ইসলামের অবর্তমানে তার উদ্যোগগুলো অব্যাহত থাকবে এটা আমাদের প্রত্যাশা।